পর্যটন-শ্রমশক্তিসহ দু’দেশের স্বার্থ রক্ষায় ৬০টি বিষয়ে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ-সৌদিআরব। দুদিনের যৌথ কমিশনের বৈঠক শেষে এর মধ্যে ৩১ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।বাকিগুলো আরো যাচাই-বাছাই করে উভয় দেশ কাজ করবে।
বৃহস্পতিবার(১৩ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের পক্ষে স্বাক্ষর করেন দলনেতা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মনোয়ার আহমেদ এবং সৌদি প্রতিনিধি দলের নেতা সেদেশের শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রি মাহির আবদুল রহমান গাসিম। পরবর্তীতে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে চুক্তির বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।
চুক্তি শেষে মনোয়ার আহমেদ জানান, দু’দেশের মধ্যে ৬০টি ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে উভয় দেশই পজেটিভ। বুধবার সৌদির এ্যাকোয়া পাওয়ারের সঙ্গে ১৮০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চুক্তি হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই সৌদি আরবের বেসরকারি বিনিয়োগকারিরা বাংলাদেশে আসবেন এবং এমওইউ স্বাক্ষরিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি সফরের পর দুদেশের সম্পর্ক অন্য উচ্চতায় গেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ইআরডি সচিব বলেন, আমরা রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বলেছি। তবে এর সঙ্গে অনেকগুলো মন্ত্রণালয় ও সংস্থা যুক্ত। তাই পরবর্তীতে আলাপ-আলোচনা করা হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যৌথ কমিশন বৈঠক দু বছর পর পর হয়। কিন্তু টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠক চলে সব সময়ই। তাই বৈঠকের আলোচনা ও সিদ্ধান্তগুলো পরবর্তীতে বাস্তবায়ন হয় টেকনিক্যাল কমিটির মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মাহির আবদুল রহমান গাসিম বলেন, রেহিঙ্গা ইস্যু একটা স্পর্শকারণ বিষয়। ইতোমধ্যেই সৌদি আরবে কিছু রোহিঙ্গা আটক রয়েছে। অনেকে জেলও খাটছে। তাদের সাজা শেষে ফেরত পাঠানো হবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এ বৈঠকের আয়োজন করে। দু’দিনের যৌথ কমিশন বৈঠকে উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা এজেন্সিগুলির উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিভিন্ন অধিবেশনে অংশ নিয়েছিলেন। মৈত্রী এবং পারস্পরিক দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের মূল বিষয়টিকে ধরে রেখে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উভয় প্রতিনিধি দল দু’দেশের সর্বশেষ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির তথ্য আদান-প্রদান করে।
এ সময় বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে সহযোগিতার ফলাফল পর্যালোচনা করে। উভয় পক্ষই বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও জোরদার করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। যেসব বিষয়ে সহযোগিতা করতে উভয় দেশ সম্মত হয়েছে সেগুলো আলোচনা হচ্ছে, বিদেশ, অভ্যন্তরীণ ও বিচার বিভাগীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই পাসপোর্ট, ওয়ার্কিং ভিসা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ভ্রমণের নথি জারি করার বিষয়ে আরও ঘনিষ্টভাবে কাজ করবে।
এছাড়া সৌদির পক্ষ জনশক্তি সম্পর্কিত বিষয়গুলি সম্পর্কে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মন্ত্রীর সাথে কাজ করার বিষয়ে তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। উভয় পক্ষ ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও মতবিনিময় কর্মসূচির জন্য বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমি (বিএফএসএ) এবং প্রিন্স সৌদ আল ফয়সাল ইনস্টিটিউশন ফর ডিপ্লোমেটিক স্টাডিজ (পিএসএফআইডিএস) এর মধ্যে সমঝোতা চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করেছে। প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করতে সম্মত হয়েছে। এছাড়া উভয় পক্ষ স্ব স্ব দেশের মধ্যে বিচারিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিয়ে কাজ করার জন্য আরও সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে। দুদেশেই মাদক নিয়ন্ত্রণ, জালিয়াতি এবং জালিয়াতির অপরাধের ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করতে আরও সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে এবং উভয় দেশে শান্তি ও সম্প্রতি বজায় রাখতে নতুন তথ্য হালনাগাদ করবে। বৈঠকে বাংলাদেশী পক্ষ তিনটি ইস্যু সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব হস্তান্তর করা হয়। এগুলো হচ্ছে, সৌদিও বিচার মন্ত্রণালয়ের ওয়েববসাইটে ট্র্যাফিক দুর্ঘটনার মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ মামলার অনলাইন জমা দেয়ার বিষয়ে সমস্যা, মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ চেক প্রদান সংক্রান্ত সমস্যা এবং ফাঁসির আদালত থেকে নিহতের উত্তরাধিকারীর নাম এবং ফাঁসি আদালতে জমা দেওয়ার মামলা সম্পর্কিত সমস্যা।
এসময় সৌদি পক্ষ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। সৌদিআরবের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্রঋণ, বিধিবিধান, বিজ্ঞপ্তি এবং এ বিষয়ে জ্ঞান সম্পর্কে বাংলাদেশিদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান ভাগ করে নিতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ পক্ষ থেকে সৌদি প্রতিনিধি দলকে ক্ষুদ্র ঋণ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার জন্য সরাসরি এমআরএ এবং পিকেএসএফের সঙ্গে সাক্ষাত করার অনুরোধ করা হয়। বৈঠক বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সৌদি প্রতিনিধি দলকে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যতের প্রকল্পগুলির বিশদ তথ্য সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছে।
উভয় পক্ষ উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্যিক পণ্যের বৈচিত্রায়নের উপর গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছে। বৈঠকে সৌদি পক্ষ সৌদি ফান্ড ফর ডেভলপমেন্ট (এসএফডি) এবং বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে সহযোগিতা জোরদরের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। উভয় পক্ষ সৌদি রফতানি কর্মসূচির (এসইপি) বাংলাদেশী ব্যবসায়িক ক্ষেত্রের উপকারভোগীদের অর্থায়নের সুবিধার জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এ বিষয়ে যৌথ অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়। সৌদি চেম্বারের কাউন্সিলের অধীনে সৌদি বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলি (এসিডাব্লুএ পাওয়ার, আরামকো, আল-বাওয়ানী, আল জোমিয়া, ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন, রেড সি গেট ওয়ে টার্মিনাল, মধু ও স্বাস্থ্য) বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছে। উভয় পক্ষই মূল দেশ, পণ্যাদি প্যাকেজিং, প্যাকেজ সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়াদিসহ উভয় দেশের শুল্ক কর্তৃপক্ষের নিয়মকানুন মেনে চলতে সম্মত হয়েছে। সৌদি পক্ষ দু’দেশের পর্যটন সম্পর্কিত সম্মেলন এবং অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পর্যটন বিশেষজ্ঞ, পেশাদার, ট্যুর অপারেটর এবং ভ্রমণ লেখকদের বিনিময়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে। বাংলাদেশ পক্ষ জেনারেল অথরিটি অফ সিভিল এভিয়েশনকে (জিএসিএ) অনুরোধ করেছে যে, বিমানকে সৌদির সঙ্গে সমান হিসাবে বিবেচনা করার এবং তার বিপরীতে উভয় পতাকাবাহী বাহককে সব দিকেই সমান বিবেচনা করতেও জিএসিএ সম্মত হয়েছে। উভয় পক্ষ বিদ্যুত খাতে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছে।