।।এম জসিম উদ্দীন – আনোয়ারা প্রতিদিন।।
কানু শাহ্ ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক দার্শনিক, আধ্যাত্বিক সাধক ও কবি । অসাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে তিনি পরমাত্মাকে, স্রষ্টাকে খুঁজছেন গানে গানে। ধর্মীয় সীমাবদ্ধতার বাইরে তিনি খুঁজেছিলেন মুক্তির পথ। তার কন্ঠে তৈরি হয়েছে মানবধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব জয়গান ।
চর্যাপদের মতো তার গানের অন্তর্নিহিত বিষয়াদি দিনের পর দিন মানুষের বোধকে ত্বরান্বিত করেছে অসাম্প্রদায়িকতার দিকে । জাতভেদ আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কানু শাহ্’র গান এক নীরব মূলমন্ত্র, চেতনার শানিত অস্ত্র ।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার পূর্বপ্রান্তে চানখালী নদীর তীরে ওসখাইন গ্রাম। সেই গ্রামেই আধ্যাত্বিক সাধক কানু ফকিরের মাজার। তিনি ছিলেন মধ্যযুগের প্রসিদ্ধ একজন কবি । ইতিহাস গবেষক, প্রবীণ সাংবাদিক জামালউদ্দিনের গবেষণামূল গ্রন্থ “দেয়াঙ পরগনার ইতিহাস আদিকাল” থেকে জানা যায়-কানু শাহ্ আরবি, ফার্সি, উর্দু ও বাংলা ভাষায় জীবনতত্ব, নীতিতত্ব, ধর্মতত্বমূলক গ্রন্থ রচনা করেন ।
এছাড়া বহুসংখ্যক পদসংগীত এবং মাতৃভাষায় নানা প্রকার ছড়া, কবিতা রচনা করে সাহিত্যজগতকে করেছেন সমৃদ্ধ । ১৯৬৬-৬৭ খ্রীস্টাব্দে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির জন্য তার স্বরচিত কবিতা “মনের মহিমা” স্থান পেয়েছিল পাঠ্য গ্রন্থে ।
তার রচিত অনেক গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য হলো আগম-জ্ঞান সাগর, সিরাজকুলব, ধ্যনমালা, খাবনামা, শাহনামা, ইসলামনামা, যোগ কলন্দর, রাগ-তালনামাসহ বিভিন্ন দাওয়াতের অজিফা। তার রচিত গ্রন্থের মধ্য আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সংগৃহীত পাঁচটি গ্রন্থের পান্ডুলিপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথিশালায় সংরক্ষিত আছে ।
একটি জাতীয় যাদুঘরে, একটি ধর্মীয় পুঁথিশালায় এবং বাকিগুলো বাংলা একাডেমিতে সংরক্ষিত আছে। কানু ফকিরের পীর ছিলেন হযরত শাহ্ কিয়াম উদ্দিন (রঃ) । পীর তাঁকে আদর করে “ওয়াহেদ কানু” বলেই ডাকতেন । ওয়াহেদ’ আরবি শব্দ, অর্থ এক বা একক ।
অতএব ওয়াহেদ কানু অর্থ “একক কানু “। শাহ্ আলী রাজা ওরফে কানু শাহ্ মুসলিম বিশ্বের প্রথম খলিফা হযরত আবু বক্কর (রঃ) এর বংশধর । তার পূর্বপূরুষরা ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য নদীপথে ভারত আগমন করেন । তৎকালীন ভারতে গৌড় নামক রাজ্যে ( মুর্শিদাবাদ) দীর্ঘদিন ধরে তারা বংশ-পরম্পরায় জীবন-যাপন করেন।
দিল্লির মোঘল সম্রাট জালাল উদ্দীন মোহাম্মদ আকবর” দ্বীন-ই- ইলাহি ” নামক নতুন ধর্ম প্রচার করার কারণে ধর্মভীরু আলেম সমাজ, অলি-দরবেশগণ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ধ্বনি উচ্চারণ করেন তখন সম্রাট আকবর তাদের উপর জুলুম, অত্যাচার, অবিচার শুরু করেন। সেসময় আলি রাজার পূর্বপুরুষ “শাহ্ হাজি দৌলত মোহাম্মদ”গৌড় থেকে চট্টগ্রামে পটিয়ার চক্রশালায় এসে বসতি স্হাপন করেন ।
আলি রাজার পিতামহ শাহ্ মনোহর আরাকানের সাথে ব্যাবসা করতেন। বার্ধক্যজনিত কারনে মনোহর আলি মৃত্যুবরন করেন। মনোহর আলী মৃত্যুর কিছুদিনের তার এক ছেলেও মারা যান। পিতা শাহ্ মনোহর এবং তার ভাইকে হারিয়ে মোহাম্মদ সাঁছি চক্রশালা ত্যাগ করে চলে আসেন চানখালী নদীর তীরে বর্তমান ওসখাইন গ্রামে। মোহাম্মদ সাঁছির ঔরষজাত পূত্র হলেন আলি রাজা ওরফে কানু ফকির। জন্ম ১৭৫৯ খ্রীস্টাব্দ। আলি রাজার শিক্ষাগুরু ও পীর ছিলেন তৎকালীন ত্রিপুরার শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ও সাধক কুমিল্লা জেলার হাজিগঞ্জের শাহ্ কিয়াম উদ্দিন । শাহ্ কিয়াম উদ্দিনের মাজার চাঁদপুরের হাজিগঞ্জে । শাহ্ কিয়াম উদ্দিনের সান্নিধ্যে এসে আলি রাজা ওরফে কানু শাহ্ আরবি, ফার্সি, উর্দূ ও বাংলা ভাষায় সুপন্ডিত হয়ে উঠেন, এবং শরীয়তের মূল ধারা ও আধ্যাত্বিক জ্ঞান লাভে সমর্থ হন ।
কথিত আছে যে, আলি রাজা প্রায় সময় বাঘের পিঠে আরোহন করে চলাফেরা করতেন । তার জীবদ্দশায় ওসখাইন গ্রামে কোন প্রকারের মহামারী দেখা দিতোনা। কোনো মূল্যবান দ্রব্য ঘড়ের বাহিরে পড়ে থাকলেও চোর-ডাকাত তা স্পর্শ করতোনা। অবসর সময়ে আলি রাজা মারফতি গান, জিকির অনুশীলন করতেন । ১৮৩৭ সালে ৮০ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন ।
আগামী ১৫ই জানুয়ারি বুধবার হযরত আলি রাজা ওরফে কানু শাহ্ (রঃ) এর ওফাত দিবস ।
এ উপলক্ষে রজায়ী যুব ত্বরিকত বাংলাদেশ” নামক সংগঠনের উদ্দ্যেগে আলহাজ্ব মোহাম্মদ খোরশেদ উল্লাহ্ রজায়ীর নেতৃত্বে ১৪ ও ১৫ ই জানুয়ারি মঙ্গল ও বুধবার দুই দিনব্যাপী মাজার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে খতমে কুরআন, খতমে বোখারী শরীফ এবং রজায়ী ত্বরিকত সন্মেলন । এতে সকলে আমন্ত্রিত ।